নির্বাচিত দশ কবিতা | ফারুক আহমেদ

নির্বাচিত দশ কবিতা | ফারুক আহমেদ

🌱

দিনগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে

একটা সংগীত দগদগে আগুনে গলিয়ে ফেলা হচ্ছে
একটা সুর ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে কলকব্জার ভাঁজে
প্যাকেট হলেই চলে যাবে ভোক্তার দোরগোড়ায়।
একটা যৌথপরিবারকে গলিয়ে ভাগ করে দেয়া হলো মৌচাক-তেজগাঁও, লন্ডন এবং ফ্রোজেন ফুডকে।

আমাদের কোনো নিহিতার্থ নেই, প্রেম নেই, স্নেহ নেই
চোখের জল নেই, আছে শুধু ধারণা।
যে ধারণা বড় হচ্ছে আধাসামরিক গবেষণাগারে;
যে ধারণা চেকপোস্টে প্রহৃত হয়ে একটি পা হারিয়েছে;
তাকে নিয়ে আমাদের সামনে দিনগুলো পেরুতে হবে।

দিনগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে,
চিরচির শব্দে কাটা হচ্ছে
কারা কাটছে, চেনো তাদের?
খানিক গুঁড়া, কিছু টুকরো
তা পেয়ে আমরা খুব আপ্লুত।
তা-ই নিয়ে যাচ্ছি ধারণার কাছে
যাচ্ছি পার্কের ভেতরে দোরগোড়ায়
আর ওখানে বাদাম ভাঙার মতো
অনেকগুলো মুখ ভেঙে পড়ে আছে।
ওখানে বাদাম ভাঙার মতো
অনেকগুলো সংসার ভেঙে পড়ে আছে
ওখানে ভাস্কর্য ভাঙার মতো
অনেকগুলো সন্ধ্যা ভেঙে পড়ে আছে।

আমরা কোথায় যাব!
একটা সংগীত দগদগে আগুনে গলিয়ে ফেলা হচ্ছে
আমাদের কোনো নিহিতার্থ নেই, আছে শুধু ধারণা।
দিনগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে, চিরচির শব্দে।
ফলে পরিশেষে, আমরা যাব আমাদের কাছে;
আর কারো কাছে নয়।

 

জোছনার তোড়া বা উপমাফুল

বালক, জ্যোৎস্না কেটে কার জন্য তোড়া বানাচ্ছো
কার জন্য বারান্দায় চাষ করছো উপমাফুল।
বালক, ভাবছো তুমি নদীগুলোকে শুশ্রূষা করে
তার ভেতর ঢেউ ফলাবে, ধরবে প্রাণবন্ত স্রোত।
বালক, যে শহর এখন ফুলেল উপত্যকার মতো সুধাময়
যে শহর ধরা দিচ্ছে একটি নীরব কচ্ছপের মতো;
তুমি ভাবছো, তাকে নিয়ে যাবে হোমারের কাছে
ভাবছো তাকে নিয়ে বসবে এরিস্টটলের সামনে।
তারপর চাষ করবে কবিতা, দর্শন, চিত্রকলা, সুর;
আর বড়শি ফেলে ধরবে ছোট-বড় হাসি-ঐশ্বর্য।
বালক, কত কত দিন খুন হয়েছে ধুলোর ভেতর;
তুমি কি জানো, লক্ষ লক্ষ সংসার মেশিনে ঢুকে
বেরিয়েছে ডলার হয়ে, বেরিয়েছে কান্না হয়ে;
বালক, তুমি উপমাফুল চাষ করো, ক্লান্ত হও;
আর ভাবো, জোৎস্নার তোড়া বানিয়ে বলবে
তোমাকে দিলাম, তোমার কোনো অসুখ নাই।

 

করোনাকালের মেঘদূত

পূর্বমেঘ
তোমার জন্য কুরচি ফুলের অধ্যায়, মেঘ
নিবেদন করা হলো অর্ঘ রূপে;
পর্বত-নিতম্ব থেকে সভ্যতার দেহ-পল্লবীর দিকে
রওনা হও গো ধুম জ্যোতি জল বায়ু সহযোগে তুমি;
অভিভূত করে দাও ফ্যাকাশে চোখগুলোকে
নগর জুড়ে বুনছে যারা পরিতাপমালা।
তোমার জন্য বিহঙ্গদলের সুধাসংগীত আর আছে
শোকে বুনন প্রিয়ার প্রতীক্ষিত মুখ দর্শনের ভাগ্য।
রওনা করো হে মেঘ, কালো সামিয়ানা আকাশের।

যাও, দেখবে গম্ভীরা নদী নাই, আছে বদ্ধ জলের সাঁতার
তার ওপর বেড়াচ্ছে রাজহাঁসের গ্রীবার মতো
আবর্জনা, ভেবে নিয়ো একে গম্ভীরা সংগীত।
বিত্তশস্যে ভরা এক আবন্ধ্যা শস্য-শহর,
তুমি কিন্তু নতজানু জলসি ন কোরো না অর্থের নিকট
প্রিয়া তবে পাবে না যজ্ঞের বিরহগাথার শৃঙ্গমালা;
পাবে না রামগিরিতে গুমড়ে ওঠা শোকের নামতা।

তুমি পূর্বদিকে যাবে সোজা, গিয়ে পাবে অবিকল
ইন্দ্রধনু পর্বতাদি, বরফাচ্ছাদনময় ধাঁধার মতো দালান,
জৌলুসের যাতায়াত, পাবে উজ্জয়নী নগর যেমন
নর্তকীর মতো স্ট্রিট লাইট আছে দাঁড়িয়ে পথে পথে
যেন সবই নির্দয় কুবেরের হৃদয়হীন ঐশ্বর্য
পাবে শৃঙ্গরূপ বাড়ি, কিন্তু চোখ দিয়ো না শার্সিতে
আটকা পড়বে তবে শৃঙ্গারে সমর্পিত শরীরে।
পাবে পথ জুড়ে জুঁইচাপা বা কদম, দাঁড়িয়ে তবে
ঘ্রাণ নিয়ো, নিয়ে নেবে প্রিয়ার সুগন্ধি বারতা তোমাকে;
দেবদারু অরণ্যের মতো পাবে মানুষের সমারোহ
ভয় পেয়ো না তাতে, ভেবো না প্রিয়াকে পারবে না চিনতে
তার হাসির ঐশ্বর্য দেখে তুমি চমকে উঠে বলবে
তোমাকে চিনে গেছি গো শোকের বৈভববতী।

তোমার বিদ্যুতে মেঘ, ভয় পাইয়ে দিয়ো না
প্রেমিকযুগলদের, এ নগরে তোমার ঝলক
নিষ্প্রয়োজন, বরং কিছুক্ষণ বৃষ্টি হয়ে ঝরো,
বালিকাদের অধর বৃষ্টির ফোঁটায় সিক্ত করে
দিয়ো অগণন ধারাপাতে, আলিঙ্গনে ফুটুক প্রেম।
তবে ফেলো না ফুরিয়ে দেহখানি একদম
জলসংগ্রহে যেয়ো সরে নগর-গহ্বর থেকে
অপূর্ব নাম সব নদী বেয়ে নিয়ে এসো ধারা;
জলে পূর্ণ করো সুখে তোমার গতরখানি।

এই বিশালায় পদ্ম নাই, আছে ভাগাড়ের তীব্র গন্ধ
তবে পাবে রমণীর দেহের ঘ্রাণের আকর।
বিদিশা নয় এ হয়ে ওঠে বিবমিষা নগরী কখনো
মানসযাত্রী বলাকা ভেবো, তোমাতে যজ্ঞের বাজি;
আর আমি যজ্ঞ হৃদয়, আমার কালিদাসের হৃদয়
আমার হৃদয় যেন সিনকানের হৃদয় হয়ে যায়;
মহাভারতে আমাকে পাবে না, পাবে জাতকে,
তোমাকে মেঘ পাঠাচ্ছি কাকদূতের শহরে
তুমি যজ্ঞ-দূত, তুমি নিগূঢ় মনোহর মুরতি।

সরল বস্তিতে যারা থাকে এখানে, তাদের
দেখেই বুঝবে এরা আসলে কৃষির পুত্র
আচ্ছাদনহীন কান্না এখানে দিনের মতো
আলো ছড়ায়, থমকে যেয়ো না কিন্তু তাতে।
তুমি এগোতে থাকবে, পুচ্ছ পুচ্ছ কথাঢেউ
গুচ্ছ গুচ্ছ প্রহসন ডিঙিয়ে যেতে থাকবে তুমি
পাবে কুরুক্ষেত্র, কাওরানবাজার বা গুলিস্তান
নামে চেনে, তবে কুরুক্ষেত্র বলো না সহসা, তবে
তোমার কালো মস্তক হয়ে যেতে পারে গুম;
ঝুম ঝুম বৃষ্টিসুরে গান ধরে বরং যেতে থাকো;
মনে রেখো বন্ধু যজ্ঞ তোমার স্কন্ধে রেখেছে প্রেমগাথা।

 

উত্তর মেঘ

অলকা অথবা ঢাকা তাতে তফাত নাই কোনো
দেখবে মেঘ, জানালা ধরে কত চোখ অপেক্ষায়।
বালিকা হৃদয় থেকে পাওয়া শব্দ ফেলে নিচে
বালক কুড়িয়ে রেখে দেয় তা বুক পকেটে;
তারপর সে শহর জুড়ে শব্দ-মুগ্ধতার ফাঁদে
গ্লাসভর্তি জীবনকে পান করে মাতাল ঘুরে বেড়ায়।
শোনো মেঘ, কৃষ্ণতনু মেঘ, লীলাকমল, কুন্দকে
যেয়ো না খুঁজতে, বৃষ্টি-শহর খুলে দেয় বুকের বোতাম,
জারুল রঙে চমকে দেয়, ফোটে কারবালার মতো
লাল কৃষ্ণচূড়া। বেলি, শিউলি আছে, আছে বালিকার
মাতাল করা চুলের ঘ্রাণ। পেলে মনে হবে
এ বহুপুষ্পের এক কুঞ্জবন; বৈভ্রাজ-রমনা।
আর বিশাল বাগান এক শহর জুড়ে, নিয়তির মতো
এক বহুরূপ হর্ন-বাগানে ঢুকে পড়বে তুমি।

এ শহরে নানা ভঙ্গিমায় ফুটপাতে পথে কাচঘেরা
ঘরে অন্ন গিলে, কিন্তু প্রেমময় চুম্বন অপ্রকাশিত।
নাগরিকেরা অশ্লীলভাবে বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে
বালিকার কোমর জড়িয়ে ধরা তো বালকের নিষিদ্ধ;
তুমি যাচ্ছো সে শহরে মেঘ।

ভয় পেয়ো না উড্ডীন হৃদয়ের মেঘ
মিনোয়ান নাবিকের মতো ছড়িয়ে পড়ো শহর জুড়ে
পাবে তবে কুয়াশার গল্প, কাঁপা কাঁপা অধরের হ্রদ
যেন পাশাপাশি দুটি আপনঘটনা, বহুদিন ধরে
শহর আঁকছে অজন্তার নাম না জানা শিল্পীর মতো।
পাবে মাইলের পর মাইল ছড়িয়ে পড়া দিনলিপি,
যেখানে আছে সবুজ গাছের মতো সারি সারি
দাঁড়িয়ে থাকা চাহনি আর কথা ও নীরবতা।
এ গল্পটি কার হতে পারে তুমি জানো মেঘ, আর
আশ্চর্য হয়ে দেখবে শহর এই গল্পকে তার বুকের
ভাঁজে রেখে দিয়েছে, যেমন যোসিফিনের উদ্যানের
চারা জেনে রেখে দিত শক্রসেনারা পরম মমতায়।

এ শহরে ভোর নামে শিউলির মতো শুভ্রতা নিয়ে;
দেখবে মোড়গুলো পুষ্পরাজিতে পূর্ণ হচ্ছে একে একে
মনে হবে তুমি কালিদাসের কালেই আছো, হবে
পরক্ষণে এক বিষণ্ণতার আকরে নিমজ্জিত তুমি;
ভাববে, পৌঁছে গেছ রোমের রোজ-মেনিয়ার পেটে;
কত-পাপড়ি প্রতিদিন খুন হচ্ছে শুভ্র-সকালের মোড়ে
যেন পুষ্পসমাধি, পুষ্পস্নান, পুষ্পনির্যাস, পৃষ্পকাম
একটি খুনি শহরের পারভার্সানে নিজেকে বিসর্জন দিচ্ছে।

ভীষণ কোলাহলের শহরে একটি মুখ ভেসে যায়;
শব্দ ভেঙেচুরে মুগ্ধতার কিশলয় রচিত হতে থাকে।
মেঘ তুমি তাকে চিনবে কীভাবে বলো…
জৌলুশঘেরা শহরে মিথ্যা সোনালি আভার মতো ফোটে;
ভুল করো না, ফুটপাতে, বৃক্ষপল্লবে কান পাতো;
নেরুদার কবিতা যেন, তীব্র একজোড়া প্রেমময় চোখ
দেখবে কী এক বিহ্বলতার আঁকছে মেঘময় দিন;
সে বুনে যাচ্ছে ভ্যান গগের মতো পরাবাস্তব রঙ;
আর তার হাসি থেকে ঝরে পড়ছে রবি ঠাকুরের
ঘোরগ্রস্ত মুগ্ধ-সুর, ডাকো তাকে উপমার জংশন।

সুতরাং মেঘ, তুমি তাকে চিনে নিতে পারবেই
নিদানকালে অস্থির প্রিয়া, যার অধরউপকূলে
নৌকার মতো একটি তিল জায়গা করে নিয়েছে;
যার বক্ষ কাঠগোলাপের ঘ্রাণময় উদ্যান, বুঝলে;
সে ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ডের উপন্যাসের মতো শ্রেষ্ঠা
অথচ পড়া হয়নি, আমি তাকে খুঁজে বেড়াই চরাচর।
পড়েছে অপূর্ব এক মুহূর্ত কেটে বানানো জামা;
আর পরে আছে অপেক্ষা, কানে দুল বানিয়ে।
তুমি তার কাছে যাও আর বলো যজ্ঞের বেদনা;
বলো যজ্ঞের বেদনা ফুটে ভরে গেছে এক বিরাট উপত্যকা।

মেঘ যাও সরোবর পেরিয়ে তার সীমারেখায়;
টের পাবে এক আচানক শুভ্র-সবুজের সুচ
বুনে যাচ্ছে ফুল-পাখি-নিসর্গের দিনলিপি।
সে যদি থাকে নিদ্রায় তবে থেমো, দিয়ো উঁকি
তার বাগানে, একটি বিকাল পাবে, তাতে ফুটেছে
লাল, নীল মুহূর্তরা, ফুটে আছে মনোহর কথাফুল;
পাবে একটি সন্ধ্যাবৃক্ষও, সেখানে ফুটেছে হাসির পালক;
সে হাসির রঙ চিনতে তুমি পড়ে যাবে গোলাকধাঁধায়;
আলো-আঁধারের একটা সান্ধ্যভাষা সেখানে দীপ্যমান;
অনেক সময় তুমি এখানে কাটিয়ে দিতে পারো।
আর যদি দেখো সঙ্গীদের নিয়ে সে গাইছে কোরাস;
তবে তা যজ্ঞের জন্য শোক, স্যাফো যেন শোনাচ্ছে
অনন্ত বিরহগাথা, চিত্রকল্পের, উপমা-উৎপ্রেক্ষার।

হে বিশালাক্ষী স্ফটিক, যজ্ঞ-বন্ধু, ভালোবাসা তোমাকে
তুমি কীর্তন আমার, তুমি একমাত্র বার্তাবাহ;
নিদানকালের বন্ধু, যাও, যাও, অনন্তবীথিকা
যজ্ঞ হৃদয়ের, পৌঁছে দাও প্রিয়ার নিকট
বেদনাহুত হৃদয়ের অনির্বাপিত শোকগাথা।

 

ঘটনা

এক সঙ্গে দুটা ঘটনা পাশাপাশি কিছুদূর গিয়ে
বিভক্ত হয়ে যায়। দুটা ঘটনা কিছুদূর এক সঙ্গে চলার পর
বিভক্ত হওয়ার এতো কি প্রয়োজন, হু! কিন্তু সত্যি সত্যি
পাতা ঝরার দিনগুলোতে একটা ঘটনা আরেকটা
থেকে বিভক্ত হয়ে যায়, পাশাপাশি সিটে বহুদূর পাড়ি
দিয়ে শেষে একটা ঘটনা আরেকজনকে বলে ‘আসি’।

যতবার সম্ভাবনা দেখি, ততবার মনে হয় এসব
সম্ভাবনাক্ষেতে ঘটনার চাষ হয়। কিছু সম্ভাবনা
চারা থাকতেই মরে যায়, আর কিছু এমন সব
ঘটনার জন্ম দেয়; যার সঙ্গী ম্যাডাম নিরবধি,
যার সঙ্গে যায় ভূত্য নিরন্তর, যাকে বহন করে
বেড়ায় কলুরবলদ কাল। এইভাবে কবে জানি! কোন এক কালে,
এই ধরো তা গতকাল হতে পারে, একটু আগে বা আগের জন্মে
একটা লাবণ্যময় ঘটনার সঙ্গে আমার দেখা হলো। নদীর মতো
সহজাত প্রবাহমান এমন ঘটনা দেখে মনে হলো- হৃদয়
ফুড়ে একটা শান্তির ফোয়ারা ভ্রমণে নামবে এক্ষুণি। মানুষ
ভ্রমণশীল হোক, পাখি, নদীও; কিন্তু শান্তি, তার কেন?
আহা, শান্তি তুমি ভ্রমণশীল বিহঙ্গের মতো হয়ে গেছো,
তোমার সঙ্গে ঘটনার জন্ম দিতে মানুষ ভীষণ উদ্গ্রীব।
অথচ তুমি এবং ঘটনা নিজ নিজ স্থানে থেকে
কী এক বিহ্বল প্রতিযোগীতার জন্ম দিচ্ছো ক্রমাগত।

 

সুমিষ্ঠ অবজ্ঞা খেতে আর ভাল লাগে না

আপ্যায়নের ভয়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না।
গেলেই মনে হয়, আপ্যায়নের বাড়াবাড়ি শুরু হয়ে যাবে
মনে হয় ট্রে-ভর্তি বিচিত্র অবজ্ঞা সামনে দিয়ে বলবে নিন।
সুমিষ্ঠ অবজ্ঞা খেতে আর ভাল লাগে না। আড়মোড়া
ভেঙ্গে বেরিয়ে পড়লে সামনে অনেক অবহেলা
সেধে সেধে বলে, নিন অবহেলাফল, অনেক সুমিষ্ঠ।

পথ কোথায় পড়ে আছে?
যে পথে গেলে কোন চেনা মুখ নেই,
কোন পথ বিস্তৃর্ণ জলরাশির মতো বিক্ষুব্ধ হয়ে ঘুরে বেড়ায়?
আপ্যায়কর্মীদের অচেনা এমন পথ আমার কাছে এলে
কানের উপর সিগারেটের মতো গুজে রাখতাম।

বড় বাড়াবাড়ি হয়ে যায়, অনুর্বর প্রত্যাশাক্ষেতে অনেক বীজ
সার, পানি দিয়েও কোন উদ্ভিতের জন্ম হয় না।

চিনিশিল্প, ইস্পাতশিল্প অনেক মানুষের কোলাহালে
তৈরি হয়; বোঝলে হে। অথচ আমি শিল্প বলে প্লেটভর্তি
অবজ্ঞা নিয়ে বসে থাকি, উড়ন্ত অবহেলা আঁকি।

 

তুমুল প্রেমের কবিতা

ঘুম আসছে না, ঘুম আসছেন না।
একটা মোবাইল কলের মতো ঘুমের জন্য প্রতিক্ষা করছি।
যার কাছে পাঠাতে চেয়েছিলাম মেঘ, তার কাছে কি
আমার ঘুম আটকা পড়েছে? মামা গেইট খুলেন
একটা সিএনজি করে আমার ঘুমকে পাঠিয়ে দেন, প্লিজ।
ঘুম আসছে না, পুব আকাশে গ্রেনেডের মতো ঝুলে
আছে চাঁদ। সারাদিনমান যেমন তুমুল দুপুরের
মতো ঝুলে ছিল একটা অনিবার্ণ- যে অনির্বাণের নাম
তাবৎশূণ্যতা। ‘প্রেমিকের চাঁদ মুখকে জসিম উদদীন
বানিয়েছিলেন চরের জমি- কেননা তার প্রেমিক কৃষক।’
এক বড় কবি তার গুলশানের ফ্ল্যাটে আজ সন্ধ্যায়
আমার কাপে ঢেলে দিলেন ধুয়া ওড়ানো এ ক’টা গরম শব্দ।
ফলে এ মুহূর্তে আমার প্রেমিকা টেমসের ব্রিজ
কেননা সে ও লন্ডন আমার কাছে আকাঙ্খায় একাকার-
দু’জন নেপথ্যে থেকে জন্ম দিচ্ছে পঙক্তি-চিত্রকল্প-উৎপ্রেক্ষার।
তখন মোবাইল বাজলো; সত্যি! সত্যি!! সত্যি!!!
না সে নয়; তবু কি আশ্চর্য দেখেন
টেমসের পাড় থেকে শম্পা, তারপর আরিফ। জানালো
ও নদীর সব পানি আমার প্রতিক্ষায় জমে যাচ্ছে আর
কিছু সাদা চামরার যুবক শুয়রের মতো কুৎ কুং করে
চলে যাচ্ছে লন্ডন এভিন্যুয়ের দিকে সুন্দরীদের নিয়ে।
ফোন শেষ হতেই আমার হিশি ধারলো ও তা ফেলতে আমি
টয়লেটে গেলাম। আহা কমোট আমার হিশির জন্য
হা করে আছে- পুঁজিপতিরা যেমন হা করে থাকে অর্থের জন্য।
ঘুম কিন্তু আসছে না, কোথাও সে আটকা পড়েছে
ঘুম আসছে না, কেন সে মোবাইল কলের মতো আসছে না।
এ ঘুম যদি ডাহুকের মতো শিকারি হয়
যদি আরেক ঘুমকে শিকার করতে যায়, তাহলে না আসুক।
যাক ঠিকানা খুঁজে, নাম্বার দেখে দেখে। কিছু বলব না।
কিন্তু আমার যে এই অনেকগুলো পঙক্তি বেরিয়ে এলো
এগুলো কি যাবে নাম্বার দেখে দেখে, ঠিকানা খুঁজে নিয়ে।

ঘুম আসছে না, হয়তো পুলিশ ওকে অ্যারেস্ট করে
জেলহাজতে বোমাবাজদের সঙ্গে আটকে রেখেছে।
এমনও হতে পারে ক্রসফায়ারে পড়েছে। বেচারি ঘুম!
রাত এখন বিগতযৌবনা- একটু পরেই এর চামরায় ভাঁজ পড়বে
রবীন্দ্রনাথের একরাত্রি’র স্রেফ একটা স্রোত…
তবু ঘুম আসছে না,
কুমারের মতো আমি প্রতিক্ষায় মৃতশিল্প বানাচ্ছি।

তুমি যতো ভালোবাসা ঢালো

তুমি যতো ভালোবাসা ঢালো
যেন ততোই বিরহ জ্বালো।
তুমি নিয়ে আসো ওয়াগন ভরে অধরচিহ্ন;
আমি খুঁটে খুঁটে খাই নীলরঙা বিরহঅন্ন।

আমাদের মাঝখানে আসে পৃথিবীর অসুখ;
তুমি নিয়ে আসো জুঁই, স্পর্শগন্ধ, অশোক।
দেখি তোমার চাহনি ফুটে ভরেছে অ্যাভিনিউ
আমি পাই না, অনেক দূরে ডাকে একটি পিউ।

যতো ভালোবাসা ফোটে
ততোই বিরহ জোটে।
বাহুডোর মুগ্ধঘোর ফালি ফালি করে অঝোরে
তোমার অন্বেষণে বেরিয়ে কম্পনে বুক ভরে।
তোমারে পাই, তোমারে পাই প্রার্থনায়-কোরাসে
যেন বিচ্ছেদ যেন বিচ্ছেদ বা কম্পিত তরাসে।
পথ ভরেছে মেঘে আবেগে মেহনে আয়োজনে
অজস্র বর্ষ থেকে আমরা পাই মুহূর্ত গুনে।
তার ভেতর জরা, রয়েছে বিচ্ছেদভরা মাঠ
তুমি হাত ধরে খুলে দাও মুগ্ধতার কপাট।
এভাবে তোমাকে পাই, পাই না তোমাকে কোথাও
এইভাবে হৃদয়কে তপ্ত হৃদয়ে তুলে দাও
এইভাবে ভালোবাসা ঢেউ আর সুরে অঝোর
যেন যুগল, যেন বিচ্ছেদে অরূপ এক স্বর।
সুতরাং তুমি যতো ভালোবাসা ঢালো
যেন ততো বিরহ অজান্তেই জ্বালো।

 

শান্ত-সুনিবিড় সুর

তুমি শুয়ে আছো;
লাগছে তোমার নাকে এসে সকালের ঘ্রাণ,
তুমি শুয়ে আছো;
তোমার ভেতর মাথা দুলাচ্ছে সবুজ এক ধানখেত।
তোমার ভেতর বয়ে যাওয়া একটি দোয়েলের শিস,
ডেকে নিচ্ছে লাল-নীল জীবনে, তোমাকে।
টের পাচ্ছোÑ পথ মাথা উঁচু করে তোমাকে দেখছে;
কাছে নিতে চাচ্ছে ইশারায়?
পড়েছে রোদের আভা ঢেউয়ের মতো
যেন ভাঁজে ভাঁজে রাখা ভালোবাসার মূর্ছনা;
এইভাবে জেগে আছে জীবনের কোলাহল।

তুমি চোখ বন্ধ করো, বাড়িয়ে ধরো নিঃশ্বাস;
টের পাবে বাতাসের স্পর্শ…
যেন প্রিয়তমা-নীরবতা; একেকটি দিনকে
শান্ত-সুনিবিড় সুরে গেয়ে যাচ্ছে।
আর জীবন নিঃশব্দে তোমাকে বুলিয়ে হাত
যাচ্ছে পাহাড়ের দিকে, হ্রদে, সমুদ্রের দিকে
যেন তোমাকে মিলিয়ে দিচ্ছে ওদের হৃদয়ে।

 

দিগন্তের দিকে এগোতে থাকি

একটি সেফটিফিনে গাঁথলাম ওফেলিয়া-হেমলেটকে
একটি সেফটিফিনে গাঁথা রম্যাঁ রল্যাঁ-রিশার্ড ভাগনার
একটি সেফটিফিনে গাঁথা হলো অরুন্ধতী-বশিষ্ঠ;
একটি সেফটিফিনে আটকালো তোমার নিঃশ্বাসের উষ্ণতা।
এভাবে একটি চতুষ্কোণঘোর তৈরি করে হওয়ায়;
ভাগনারের সুরের গলিপথে ভাসিয়ে দেওয়া হলো।
এ চতুষ্কোণ একটি অঙ্কের মতো জীবনের ভেতর জাগলো;
দেখতে পাই তরঙ্গের মতো একটি বিকাল কথা নিয়ে আসছে;
আসছে কথাবেলি, আসছে কথাজবা, আসছে কথার সিম্ফনি;
জীবন কত ভাষার টানেলে ঢুকে আবার বেরিয়ে আসে
জীবন একটি ঢেউয়ের মতো আরেকটি ঢেউকে খুঁজে বেড়ায়
একে কী নাম দেবো!
গন্ধরাজ, মহামায়া, না হাতের তিল যেন
একটি গাছে একটি কালো কোকিল বসেছে চিরকালের।
ডাকি, যেভাবে ডাকে গহিন অরণ্য পাতার মর্মরকে
ডাকি, যেভাবে ডাকো তুমি, হুবহু ধারাপাত;
তবু কি মিলে?
আমরা স্পর্শের ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে এগোই;
একটি বিপন্ন জনপথকে ঠোঁটে গেঁথে এগোই;
এইভাবে দিগন্তের দিকে এগোতে থাকি।

বৃষ্টি নেমে আসছে, তুমি নেমে আসছো

আমরা মহানগরে থাকি, মহানগর মানে কি স্বপ্নের ভাগাড়!
মহানগরের কোথায় সকাল রোপন হয়, তুমি কি তা জানো?
মহানগরের কোথায় সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে বসে বৃষ্টির সঙ্গে
সে টেবিলের খোঁজ তুমি কি জানো?
উদ্যত পৌরুষের মতো দাঁড়িয়ে থাকা অগণিত দালান
কি তেড়ে আসছে আকাশের দিকে…
আকাশ কি ১৬ বছরের একটি অসহায় বালিকা!

আসো বৃষ্টির কথা বলি, দালান আর দালানের শহরে
বৃষ্টি এসে আমাদের হাতে ধরিয়ে দেয় মুহূর্তের বৃষ্টিঅরণ্য;
আমরা শহর থেকে কিছু সময়ের জন্য অরণ্যগাথায় ডুবি
একটি স্বচ্ছসলিলা অরণ্যের ভেতর বিহ্বল হয়ে থাকি।
ঊরুর মতো নরম বৃষ্টি নেমে আসছে, নেমে আসছে;
নেমে আসছে তোমার চাহনির মতো কোমল বৃষ্টি।

এ দেশ ষড়ঋতুর
শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম এবং তুমি।
অর্থাৎ দূরে দাঁড়ানো কুয়াশার পর্দা সরিয়ে দেখি, তুমি ঝরছো।
তুমি টিনের চাল থেকে এমনভাবে ঝরছো, যেন চুলÑ
টিনের চাল থেকে স্বচ্ছ চুলের ভাঁজ পড়েছে মাটিতে।
তুমি ষড়ঋতুর মধ্যে একটি ঋতু, মানে বৃষ্টি
মানে ঊরুর মতো নরম একটি আদিগন্তরেখা।

আমার পিঠ ভরে যাচ্ছে বৃষ্টিতে
আমার কথা ভিজে যাচ্ছে বৃষ্টিতে
আমার চোখ সরছে না বৃষ্টির মুখ থেকে
বৃষ্টির বাহুডোরে একটি উপমার দিন
বিকিয়ে দিয়ে আমি
ঊরুর মতো নরম বৃষ্টির দিকে যাব, যাব গো…

 

🌿 কাব্য ভাবনা 🌿

আমার সঙ্গে দৃশ্যেরা থাকেন | ফারুক আহমেদ

প্রতিদিন আমি অনেক দৃশ্যের ভেতর দিয়ে যাই। প্রত্যেকেই যায়। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা দৃশ্যের জগৎ থাকে। অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার মতো মানুষ অনেক দৃশ্যের মুখের সঙ্গে পরিচিত হয়। আমার এসব দৃশ্যে থাকে- রিক্সা, বাস, ট্রাক, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অনেক গাছের সমারোহ (যদিও এ সমারোহ ওদেরকে একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি দিতে পারে না), নারী, বিকাল, জানালার পর্দা, বাতাস বা এমনি অজস্র শব্দ ও নিঃশব্দের আয়োজন। এর সঙ্গে ঘুরে ফিরে আসে শৈশবের বিকালগুলি, আসে সবুজ ধানক্ষেত, সরু খাল, দুপুরের পেটে ছুরির মতো বিদ্ধ হওয়া দোয়েলের শিস, সরিষার হলুদ ক্ষেত, শিশির ভেজা সকাল, আমার মা-বাবা, ছুটির ঘণ্টা, অনেকগুলো কিশোরীর যাতায়াত, বকুল ফুলের ঘ্রাণ, অপরাজিতার মুখ- সর্বাপুরি আমার ব্যক্তিগত যাদুঘরে দৃশ্যের অধিকার সর্বাধিক।

এসব দৃশ্যের কথা আসায় আমার মনে পড়ে যায় লাইব্রেরির সামনে থেকে ধীরে ধীরে চলে যাওয়া দুপুর, একজন সুন্দরীর হাসির বুলেট, ব্রেডের সঙ্গে মাখিয়ে খাওয়া কোন সকালের যাতায়াত, আমাকে মুগ্ধ করতে ব্যস্ত আমার জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের সারি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে সদ্য অতীত হওয়া এমন সব দৃশ্যও আমার কৈশোরের দৃশ্যের মতো নিজের ভেতর গভীর উদ্বোধনের জন্ম দেয়। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা যখন পুরো শহরের বুকে আমাকে উগড়ে দিল, তখন মনে হলো, এভাবে একদিন আমার জীবন মৃত্যুর কাছে আমাকে উগড়ে দেবে। যৌবন পার করার আগেই আমি একজন বৃদ্ধের মতো অনবরত স্মৃতিকাতর হয়ে উঠি এবং বার বার মনে হয় সবসময় আমার পাশে থাকুক এক টুকরো সবুজ, একটা হাসি, কিছু লাবণ্যময় কথা। এই স্মৃতিকাতরতা, এই প্রত্যাশা আসলে নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব, কবিতার যাতনা বা এমনি সব বিষয়ের সঙ্গে মিলেমিশে জীবনকে ভালবাসার নামান্তর। এ কবিতার তাড়নায় একজন যুবকের অসহায় আকুতি ছাড়া আর কিছুই নয়।

আমার ছোট্ট কবিতার জগৎ ঘিরে রেখেছে আমার প্রাত্যহিকতা। এ ক্ষেত্রে কবিতার ফর্ম- মাত্রা-ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদির আবশ্যকীয়তা দূরে রেখে অনায়াসে আমার আত্মার নির্মিত সৌধকে উচ্চারণ করতে চাই। সব সময় চাই আমার আত্মার উচ্চারিত বর্ণমালা বেরিয়ে এসে একেকটি পঙ্ক্তির অবয়ব গ্রহণ করুক। এতে যদি কোন দৃশ্যের জন্ম হয় তাহলে আমি আপ্লুত, যদি একটা উৎপ্রেক্ষার আগমন ঘটে তাহলে আমি বিহ্বল হয়ে ঘন ঘন, দীর্ঘ দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে পৃথিবীকে অনুভব করার চেষ্টা করি, একটা উপমা সুন্দরীর রক্তিম কপোলের থেকে আমার কাছে অধিক মনোহর ও প্রার্থনীয় মনে হয়। আমার মনে হয় আমি কবিতা সাধনায় নিজেকে নিমজ্জিত করে পৃথিবীময় বিস্তৃত নিসর্গের মহারাজায় রূপান্তরিত হলাম। পাখিরা, মাছেরা আমার এ বিজয়ে উৎসবে মেতে ওঠে। এরকম ভেবে ভেবে নিজের ভেতর তৃপ্তির ফোটা ফোটা দৃশ্য জমা করি। আর যারা আমার কবিতার জন্য উৎসবে মেতে ওঠে, তাদের জন্য পুনরায় টেবিলে প্রার্থনায় বসি। এ কবিতার চরণে আত্মাহুতি ছাড়া আর কী!

কিন্তু কেবলই কি দৃশ্য? পদ্মায় জেলেদের জাল ফেলে মাছ ধরার দৃশ্য স্রেফ দৃশ্য হয়ে ধরা দেবে আমার কাছে, তা কি করে হয়। আমার তো জলের বি¯তৃত ঢেউকে জ্যোৎস্নার প্রহেলিকা বলে মনে হয় আর জেলেদের জ্যোৎস্নার শিকারি। প্রতিদিন সংসদ ভবনের সামনে দিয়ে যেতে যেতে একসারি গাছকে মনে হয় পৃথিবীর তাবৎ অরণ্যের প্রতিভূ। এসব দৃশ্য আমার ভেতর নিদারুণভাবে খেলে, বার বার বৈঠা চালায়। একটা মফস্বল শহর, যেখানে আমি বড় হয়েছি, তা আমার কাছে পরম কবিতা হয়ে নাড়িয়ে দেয় মর্মমূল।

এভাবে মানুষের স্মৃতিতে যতো দৃশ্য থাকে, সেসব কিছু দিয়ে মানুষের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক স্থাপন করি। আমার সত্তা যে সব দৃশ্যে ব্যথিত হয়, অন্যজনের সেরকম হয়; আনন্দবোধের বিপরীতে অন্যজনও আনন্দ বোধ করে- এরকমটা সত্য বলে মানি। কোন আপেক্ষিক ভাবনাই এর বাইরে আমাকে নিয়ে যেতে পারে না। সকলের সঙ্গে আমার আত্মার যোজন, বোধের যোজন।

কবিতার প্রসঙ্গ এলে দৃশ্যের সঙ্গে অনেকগুলো মুখও চলে আসে, সে সব মুখ কবি নামক যন্ত্রণা বহনকারী কিছু মানুষের। আমি জীবনানন্দের বিষন্ন মুখের সঙ্গে কি করে যেন বরিস পাস্তারনাকের মুখের সাদৃশ্য পেয়ে যাই। মেকি সব আয়োজনের ভেতর নিঃশব্দে টুপ টুপ করে বৃষ্টির আওয়াজ আমাকে দু’মুখের সম্মিলনে সহসাই চমকিত করে দেয়। অনুভব করি এ হলো আত্মকথনের মতো করে মানুষের সকল বিস্ময়-সৌন্দর্যের কথা বলে যাওয়া। বিনয় মজুমদার আমাকে শিখিয়ে দেয় গণিতের সঙ্গে কবিতার মিল মনে হয় কবি কবিতায় একটা সরল অংক তৈরি করছে। হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পাই চকচকে মুদ্রার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শহীদ কাদরীর নানা পঙক্তিমালা। অথচ মধুসূদনের নিনাদের মতো গম্ভীর স্বর আমি কিভাবে ভুলি। আর এমন সব আয়োজন মাথায় নিয়ে নিঃসঙ্গ গলি দিয়ে যেতে যেতে মনে হয় ‘কবিকে দিও না দুঃখ, দুঃখ দিলে সে-ও জলে স্থলে/ হাওয়ায় হাওয়ায়/নীলিমায় গেঁথে দেবে দুঃখের অক্ষর।’ এইভাবে শেষ পর্যন্ত কবিতাকে, কবিতাদেবীর সঙ্গে আমার সংসারকে মনে হয় অমিতের সাজানো সংসারের মতো। যাকে প্রতিদিন নতুনভাবে সাজাতে হবে। কখনও পুরনো হবে না। যদি তাই হয়, তাহলে এ জীবনে যে এক আশ্বর্য দ্যুতির আভায় পার হয়ে যাবে তা ভেবে আমি আহ্লাদিত।

যা হোক, প্রতিদিনের আপাত দৃশ্যের বাইরে যে অন্য একটা দৃশ্যের জগৎ আমার ভেতর ঘুরে বেড়ায়, তাকে আমি কবিতার ভেতর স্থাপন করতে চাই; কবিতা বলেই। চাই অন্যরা সেটুকু অনুভব করুক। ভাবুক আমরা, মানুষেরা এভাবে ভাবি। আমার বালিশের নীচে চাপা পড়ে আছে যে নদী, তার কথা জানিয়ে দিতে চাই। এতে নিশ্চুয় বুঝতে সমস্যা হবে না একটা খরস্রোতা নদীর কত ক্ষমতা। ভাঙ্গাগড়া, উত্তাল-নিশ্চুপতা বা কত কত বিচিত্র তার রূপ। তেমনি একটা নদী আমার বালিশের নীচে চাপা পড়ে আছে- এ কথা সকলকে বলে রাখলাম।

অনুধ্যান

Leave a Reply

Next Post

পথরেখা : আমার ইদ | মোহাম্মদ বিলাল

Thu May 13 , 2021
পথরেখা : আমার ইদ | মোহাম্মদ বিলাল 🌱 সাব টাইটেল ইদ হলেও এবং নতুন কাপড় কিনতে হলেও, কেনা মানে আজকের দিনের মতো রেডিমেইড কাপড় তখনও গ্রামে গঞ্জে পাওয়া যেত না। এজন্য খলিফা দিয়ে শার্ট বানানো হতো। কিন্তু শার্টের মাপ দেওয়ার জন্যেও আমাদের বাজারে যাওয়ার নিয়ম ছিলা না। এক্ষেত্রে পুরাতন শার্ট […]
Shares